মিনি ম্যালিস্ট
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
_ শুনছো গো, এদিকে একটু উঠে এসো। আমার একটু দরকার আছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাইরের ঘরে বসে থাকলে হবে তো? পারেও বাবা! যুবক থেকে বৃদ্ধ হয়ে গেল তবুও এই নেশা ছাড়তে পারলো না।
– খক খক করে দুটো কাশি দিয়ে ঘরে ঢুকলেন পঁয়ষট্টি বছরের অংকের মাস্টার মশাই অমল কান্তি সিংহ। মানুষের নাম রাখার পিছনে অন্যদের দূর দৃষ্টি থাকতে পারে। কিন্তু পদবীটা লোক ভাগ্য গুনে পায়। তবে অমল কান্তি বাবুর পদবীখানা তার চরিত্রের সাথে অদ্ভুত ভাবে প্রাসঙ্গিক।
বয়স পঁয়ষট্টি হলে হবে কি এখনও টাট্টু ঘোড়ার মতো দৌড়াতে পারে। যুবক সিংহের মতো গর্জনও করতে পারে।দেড়-দু কিলোমিটার রাস্তা যাতায়তের জন্য নিজের স্কুটার খানা ভুলেও বের করেন না। হয় কখনো সাইকেল কিংবা চরণ বাবুর ট্যাক্সি। যদিও এর জন্য পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু মহল সামনে পিছনে ওনাকে নিয়ে নানা রসিকতা করে।
কেউ বলে, মাস্টার মশাই এত পয়সা খাবে কে? সন্তান তো একটি।
আবার কেউ বলে, টাকায় ঘুন ধরে যাবে তো। আবার কোন শুভাকাঙ্ক্ষী বলে, অনেক তো রোজগার করলেন এবার তো একটু আরাম করুন।
তবে অমল কান্তি বাবু গর্বের সঙ্গে ওনাদের এইসব কথার উত্তর দেন, মশাই গ্ৰাম ছেড়ে শহরে এসেছি কামাতে, কমাতে নয়। এই বয়সে ফিট আছি। তাই তো সাইকেলিং করতে পারি। আপনারা শুধু আমার পেট্রোল খরচার সাশ্রয়ের কথা ভাবছেন। আমি মনে করি, আমি ওষুধ পত্রের খরচা, ডাক্তারের খরচা বাঁচাচ্ছি।
এইরকম মোক্ষম জবাব পেয়ে অমল কান্তি বাবুর পরিচিতরা তো একেবারে ধরাশায়ী হয়। যোগ্য জবাব যেন ওনার ঠোঁটে লেগেই থাকে। এই হেন অমল কান্তি বাবু কিন্তু আজ সাত সকালে গিন্নির বাক্যবাণে বিদ্ধ হয়ে পড়ানোর ঘর থেকে ভিজে বেড়ালটির মতো ঘরে ঢুকে বলেন, কী হলো গো দিদিমণি? মুদিখানার কী জিনিস ফুরিয়েছে? বলেছি তো লিস্ট করে রেখে দেবে। আমি পড়ানো থেকে ফুরসৎ পেলেই ঠিক এনে রাখবো।
অমল কান্তি বাবুর স্ত্রী সেফালীও দর্শনের শিক্ষিকা। তার প্রতিটি কথাতেই আছে নির্দিষ্ট যুক্তি। তিনি বলেন, মুদিখানার জিনিস ছাড়া কি এই বয়সে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে আর কোনো কথা থাকতে পারে না?
-আহা দিদিমণি, চটছো কেন? বল না কি হল? তবে যা বলবে গৌরচন্দ্রিকা একটু কম করে বলবে। নটার মধ্যে প্রথম ব্যাচটা ছেড়ে সাড়ে দশটায় দ্বিতীয় ব্যাচ নিয়ে বসতে হবে।
– আগামীকাল মেজদার ছেলের বিয়ে। সেকথা নিঃশ্চয় মনে আছে। আর সেই জন্য আজ বড়দি, বড় জামাই বাবু ও ওদের নাতনি রিয়া আসছে এখানে। আমাদের বাড়িতেই উঠবে ওরা।
অমল বাবু কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে, বিয়ে বাড়ি তো তোমার মেজদার বাড়িতে আমাদের বাড়িতে তো নয়। আমাদের বাড়িতে ওনাদের আগমনের হেতু?
– তোমার মুখে কি কিছুই আটকায় না। মেজদার বাড়িতে ভীড় খুব হবে তো। তাই এখানে উঠবে।কতবছর বাদে দিদি, জামাই বাবু আসছে। আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে। আমাদের নতুন বাড়িখানাও তো ওরা প্রথম দেখবে।
– সে তো না হয় হলো। আসল কথাটা একটু ঝেড়ে কাশো তো তাড়াতাড়ি।
– তুমি পড়িয়ে উঠে বাজারে গিয়ে বড় সাইজের কাতলা মাছের পেটির দিকটা আনবে। রাঁধুনি মাসিকে বলবো, ভালো করে ফুলকপি দিয়ে মাছের ঝোল করতে। আর আধ কিলো মতো মাটন এনো। রাতে রুটির সঙ্গে মাটনের ঝোল। একটু রসগোল্লাও নিও।
– বাবা এতো বেশ ফর্দ দেখছি । তোমার দিদি জামাই বাবুর তো যথেষ্ট বয়স হয়েছে। এতো খেয়ে শরীর ঠিক থাকবে তো। তারপর বিয়ে বাড়ির খাওয়া দাওয়া।
সেফালী দিদিমণি চোখগুলো বড় বড় করে তাকিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে ঠাকুরের বাসনগুলো মাজতে বসলেন। আর মনে মনে বলতে লাগলেন, শুধু কিপটেমি। আত্মীয় স্বজন আসবে শুনলেই খরচের চিন্তা।
অমল বাবু সকালের ব্যাচটা ছেড়ে টিফিন পর্বটা সেরে সাইকেলটা নিয়ে ছুটলেন বাজারের দিকে।
কাতলা মাছের কিলো ২২০টাকা। আর সেখানে রুই মাছের কিলো১৮০টাকা। তার ওপর পেটির অংশটাই কেবল নিতে বলে দিয়েছে গিন্নি। গোটার থেকে কাটা মাছের দাম সব সময় বেশি। সুতরাং রুইমাছ কেনার সিদ্ধান্তই নিলেন।
মাটনের দোকানের সামনে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ক্যালকুলেশন করলেন। আগামীকাল তো বিয়ে বাড়ি। কনের বাড়ি বেশি দূরে নয়। মাত্র আধঘণ্টার পথ। বরযাত্রী যাওয়া যেতেই পারে। সেখানে অবশ্যই খাসি হবে। সুতরাং পরপর দুদিন মাটন খাওয়া এই বয়সে কারোর জন্যই ঠিক হবে না। তার থেকে ভালো মুরগির মাংস। সহজ পাচ্য ও সহজ লোভ্য। সুতরাং ৫০০গ্ৰাম মুরগির মাংস, ৭০০গ্ৰাম রুই মাছের পেটি ও আট টাকা দামের দশ পিস রসগোল্লা নিয়ে অমল কান্তি বাবু বাড়িতে ফিরলেন।
বাড়ির মেন গেট অর্থাৎ বাঁশের গেটটা খুলতে খুলতেই অমল বাবুর কান বুঝতে পারলো যে তার বড় শালীরা এসে গেছে।
বড় শালীপতি ভাই তো অমল বাবুকে দেখা মাত্রই উচ্চস্বরে বলে, আরে অমল এসো এসো।কত বছর পর দেখা হলো। তুমি তো ভায়া একি রকম আছো দেখছি।
অমল বাবু বিনয়ের সুরে বলে, সবই আপনাদের আশীর্বাদ আর আপনার ছোট শালীর সেবা যত্ন। আপনারা গল্প টল্প করুন। আমার দ্বিতীয় ব্যাচের ছেলে মেয়েরা এসে গেছে।
শালীপতি ভাই বলে, অনেক বছর তো টিউশনি পড়ালে। এবার একটু বিশ্রাম করো, ধর্ম কর্ম করো, বেড়াতে-টেরাতে যাও। কর্তা গিন্নি দু’জনেই পেনশন পাচ্ছো। একটি মাত্র ছেলে। সেও ভালো চাকরি করছে। আর নাই বা পড়ালে টিউশন।
অমল বাবু বাজার থেকে এসে হাত পা ধুয়ে গামছায় মুছতে মুছতে বলেন, দাদা আপনারা শুধু আমার টিউশনি পড়িয়ে অর্থ উপার্জন টুকুই দেখলেন। এত বছর আমার হাত দিয়ে কত প্রতিভাবান ছাত্র ছাত্রী বেরিয়েছে সেটার কি পরিসংখ্যান আপনাদের কাছে আছে? একজন নিষ্ঠাবান ও অভিজ্ঞ শিক্ষক কিন্তু সমাজের সবচেয়ে বড় বন্ধু। গুরু গম্ভীর গলায় উত্তরগুলো দিয়ে গেলেন অমল কান্তি সিংহ মহাশয়।
গম্ভীর স্বরে বললেন, আমি কিন্তু পড়াতে বসছি।এক কাপ চা পাঠিয়ে দিও।
সেফালী দিদিমণির বড় দিদি বলে, অমল কিন্তু একি রকম আছে। আগের মতোই ঠোঁট কাটা। তা ঘরে ঢোকার সময় দেখলাম মেনগেটটা বাঁশ দিয়ে বানিয়ে রেখেছিস। কেন বাপু একখানা লোহার ছোট গেট বসিয়ে দিলেই হতো। কত আর খরচা?
সেফালী দিদিমণি বলে- লোহার গেট লাগানোর কথা বললেই বলবেন, এই ছোট একটা লোহার গেটের জন্য আমাদের বাড়ির নিরাপত্তার কোনো অভাব হচ্ছে না। এই গেটটা বাঁশের থাক বা লোহার। উদ্দেশ্য কিন্তু আমার বাগানে যাতে গরু, ছাগল ঢুকে না পড়ে। এখনও ঘরের ভিতরে টুকিটাকি কাজ বাকি। সব সামলে তার পর পাঁচিলের লোহার গেটটার কথা ভাববো। সুতরাং আমারও আর কিছু বলার থাকে না।
তারপর সেফালী দিদিমণি কিছুক্ষণ হেসে বলে- বড়দি তুমি তো শুধু বাঁশের গেটটা দেখলে। এই যে বাগান তা উনিই পরিষ্কার করে রাখেন। মালি করতে বললে বলবেন, মালির থেকে আমার গায়ের জোর কি কম? ফালতু মালির পিছনে পয়সা নষ্ট করা। জানো বড়দি সবজি ওয়ালাদের সঙ্গে এক টাকা, দু’টাকার জন্য এমন দর কষাকষি করবে তোমাকে কি বলবো।
আমি বিরোধীতা করলে বলবেন, পাঁচ জায়গা থেকে এক টাকা, দু’টাকা করে কমাতে পারলেই পাঁচ-দশ টাকার সাশ্রয়। ফ্রী-তে ১০০গ্ৰাম কাঁচা লঙ্কা হয়ে যায়।
সেফালী দিদিমণির বড় জামাই বাবু বলেন- অঙ্কের মাস্টার। তাই হিসেবে খুব পাকা। সেসব তো ঠিক আছে। তবে অমলের কিপটেমির স্বভাবটা রয়েই গেল।
ঘরে ঢোকার সময় দেখলাম একটা নীল রঙের হাওয়াই চপ্পল পড়ে আছে উঠানে। সেটার ছেঁড়া ফিতেটাকে নাইলন দড়ি দিয়ে সেলাই করে রেখেছে বেশ। কি ভাবে করলো বলতো? এই কথা শেষ করে হো হো করে হেসে উঠল সেফালীর বড় জামাইবাবু।
সেফালী দিদিমণিও পাল্লা দিয়ে বলে- শুধু কি হাওয়াই চপ্পলের ফিতে, বাজার করার ব্যাগের হ্যান্ডেল, পুরানো প্ল্যাসটিকের ঝুড়িগুলোতেও ওনার হাতের কেরামতি দেখতে পাওয়া যাবে।
সেফালী দিদিমণির বড় দিদি একটু ধমকের সুরে বলে, অনেক হয়েছে শালী জামাইবাবুর মশকরা। এবার অমলকে নিয়ে চর্চা বন্ধ কর। হ্যাঁ রে সেফালী, তোরা মেজদার বৌমাকে কি দিচ্ছিস? তোদের তো দুটো ইনকাম। সোনা তো অবশ্যই দিচ্ছিস।
সেফালী দিদিমণি খানিকটা মুখ চুন করে বলে- আমি বলে ছিলাম এক জোড়া হালকা সোনার দুল দিই। উনি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, তোমার বড়লোক দাদার বৌমা বিয়েতে অনেক গয়না পাবে। ওকে আর সোনা দিয়ে কাজ নেই। তার চেয়ে বরং একটা শ্রীরামকৃষ্ণের কথামৃত দেবো। পরবর্তী জীবনে কাজে লাগবে এবং অবশ্যই আমার বাজেটের মধ্যে।
সেফালী দিদিমণি আরো বলে, কি জানো বড়দি দর-দাম, বাজেট এই শব্দগুলো ওনার রক্তে মিশে গেছে। স্কুল মাস্টারি চাকরির শুরুতে মাস্টারদের আর কত টাকাই মাইনে ছিল। বামফ্রন্ট আমলে মাস্টারদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটলেও ওনার মানসিকতার কোনো পরিবর্তন ঘটল না। কি আর করা যায় বলো.. নিজে ও খরচ করবে না আর আমাকে ও করতে দেবে না। কত আর অশান্তি করবো। আর কটা দিনই বাকি আছে। এইরকম ভাবেই বাকি দিন কটা কাটিয়ে দেবো।
এমন সময় সেফালী দিদিমণির মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। ফোন ধরা মাত্রই অপর প্রান্ত থেকে ওদের কাজের মাসি বলে ওঠে, দিদিমণি আমার নাতিটা পাঁচিল থেকে পড়ে মাথা টো ফাটাইছে।সরকারি হাসপাতালে আজ ডাক্তার নেই কো। তাই ওকে প্রেরাইভেট নার্সিং হোমে নিয়ে আইলুম। এখানে বলছে ,ডাক্তার, ওষুধ সব লিয়ে হাজার টাকা লাগবেক। আমি আমার নাতনিকে পাঠাচ্ছি। আপনি উর হাতে টাকাটা দিয়ে দিবেন।
সেফালী দিদিমণির উত্তরের অপেক্ষা না করেই কাজের মাসি ফোনটা কেটে দিল। সেফালী দিদিমণি মহা চিন্তায় পড়লেন। এই এতটাকা দিয়ে বাজার করে আনলো, বিয়ে বাড়ির গিফট্ এর খরচা তার ওপর আবার বাড়তি হাজার টাকার কথা শুনলেই কি যে করবে অমল বাবু তা বেশ বুঝতে পারছেন তিনি।
সেফালী দিদিমণির বড় দিদি তো পাশেই ছিলেন। উনি বললেন, তোর কাছে যদি টাকা থাকে তাহলে দিয়ে দে। অমলকে জানানোর দরকার নেই।
খুব চিন্তিত মুখে সেফালী দিদিমণি বলেন- সে না হয় জানালাম না। কিন্তু মাসির নাতনি এই বাড়ীতে কেন এসেছিল জিজ্ঞাসা করলে কি বলবো? আমি বাপু অহেতুক মিথ্যা কথা কইতে পারি না। তার চেয়ে ভালো ওনাকে ডেকে মাসির বিপদের কথা জানাই। উনি কিছু তো দেবেন। বাকিটা না হয় আমি দিয়ে দেবো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজের মাসির নাতনিকে বাঁশের গেটটা ঠেলে ভেতরে আসতে দেখে অমল বাবু নিজে থেকেই উঠে আসে অন্দরের দিকে। এসে সব শুনে কোন নার্সিং হোম, কোন ডাক্তার ইত্যাদি খুঁটি নাটি তথ্য জেনে তিনি কাজের মাসির নাতনিকে বলেন- ওরে হাজার টাকা তে হয়ে যাবে? ডাক্তারের ভিজিটই তো পাঁচশ টাকা। ঠিক আছে তুই দাঁড়া। দেখছি আমার কাছে কত আছে।
শোয়ার ঘরের দরজার পিছনে টাঙানো হাফ শার্টের বুক পকেট থেকে একটা সাদা খাম বের করে টাকাগুলো গুনে দেখলেন। তারপর আবার খামে ভরে টাকাগুলো কাজের মাসির নাতনির হাতে দিয়ে বলে, যা লাগবে খরচ করিস। আর যদি কিছু বাঁচে ফিরত দিয়ে যাবি। ঠিক আছে।
কাজের মাসির নাতনি চলে যেতেই সেফালী দিদিমণি বলেন- কি গো? তুমি তো আচ্ছা মানুষ! হাজার টাকা দিয়ে আবার ফেরৎ এর আশা করছো? বলিহারি বাবা।
অমল বাবু উত্তর দেবার আগেই সেফালী দিদিমণির বড় দিদির নাতনি রিয়া বলে ওঠে- ও ম্যাডাম ঠাম্মি স্যার দাদু তো হাজার টাকা দেয় নি। বরং দু হাজার টাকা দিয়েছে কাজের মাসির নাতনিকে। আমি তো তোমাদের বেডরুমের খাটে বসে ছিলাম। বসে বসে দেখলাম স্যার দাদু জামার বুক পকেট থেকে সাদা খামটা বের করে চারটে পাঁচশ টাকার নোট গুনলো। তারপর আবার খামের মধ্যে রেখেই কাজের মাসির নাতনিকে দিল।
রিয়ার মুখ থেকে কথাগুলো এসে সোজা বিদ্ধ করলো সেফালী দিদিমণি, বড় দিদি, বড় জামাই বাবুকে। ওনারা প্রত্যেকে বাক্যহারা। বড় দিদি মনে মনে বলতে লাগলো, ইশ্ এই মানুষটার কিপটেমিকে নিয়ে আমরা কত সমালোচনা করি, কত হাসি মজা করি। কিন্তু আমরা নিজেরাই কতটা ভুল কাজ করি।
কিছুক্ষণ নিঃস্তব্ধতার পর সেফালী দিদিমণির বড় জামাই বাবু বলে ওঠেন, সত্যি অমল তোমাকে বাইরে থেকে দেখে তো বোঝা যায় না তোমার এত বৃহৎ হৃদয় আছে। আমাদের চোখে তোমার পাই পয়সার হিসাবটাই চোখে পড়ে, তোমার এক ঢোল এক কাঁসি জামা কাপড়, মলিন পায়ের জুতো, একেবারে সাদামাটা জীবন যাপনের অভ্যাস। পয়সার প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও তোমার simplicity-কে আমরা কিপটামি, কঞ্জুস এইসব হীন শব্দে আখ্যায়িত করি।
কিশোরী রিয়া তার দাদুকে থামিয়ে বলে- স্যার দাদুকে আজ থেকে আর কেউ কঞ্জুস, কিপটে বলবে না। আজ থেকে স্যার দাদুকে সবাই আমরা বলবো ‘ মিনি ম্যালিস্ট’।
সেফালী দিদিমণির বড় জামাই বাবু চশমাটা নাকের ডগায় রেখে বলেন- কি বললি মিনি ম্যালিস্ট? মানেটা ঠিক বুঝলাম না।
রিয়া বলে- বড়দাদু মিনি ম্যালিস্ট মানে হলো, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু নিয়েই বাঁচা।
কিশোরী রিয়ার মুখ থেকে এই নতুন ইংরেজি শব্দটা শুনে সেফালী দিদিমণি বলে, সত্যি রিয়া তুই আমাদের দেখার দৃষ্টি ভঙ্গিটা বদলে দিলি। আমরা নিজেদের মতো করেই অন্য কে সবসময় দেখার চেষ্টা করি। আর এইখানেই হয় বিপত্তি। আমি তোর স্যার দাদুর সঙ্গে এতবছর ঘর করেও লোকটাকে চিনেও না চেনার ভান করি মাঝে মাঝে। সত্যি রে রিয়া সোনা, তোর মনের সরলতা দিয়ে তুই কিন্তু তোর স্যার দাদুর দৃষ্টি ভঙ্গির সুন্দর বিশ্লেষণ করলি।
অমল কান্তি সিংহ বাবু এবার একটু হেসে বলে- গিন্নি আমি সমালোচকদের মাথার ওপর রাখি বুঝলে। আরে, তোমাদের মতো সমালোচক আছে বলেই তো কোনদিন বেহিসাবি হই নি। আজ পর্যন্ত কারোর কাছে পাঁচ টাকা ধার করি নি।
সেফালী দিদিমণি হেসে বলে- সরি সরি সরি। আমার খুব ভুল হয়ে গেছে। এবার থেকে তোমাকে আর কিপটে বলে নিন্দা করবো না বরং এবার থেকে মিনি ম্যালিস্ট বলবো। তারপর সকলে একসাথে হো হো করে হেসে ওঠে।
অমল কান্তি সিংহ বাবু এবার একটু হুঙ্কার দিয়ে বলে, অনেক ক্ষণ আমার নামে অনেক চচ্চড়ি হলো। এবার সবার জন্য আদা দিয়ে কড়া চা করো দেখি।
রিয়াকে কাছে ডেকে প্যান্টের পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে ওর হাতে দেয়।আর বলে, যদি প্রয়োজন হয় তবেই খরচ করবি।না হলে যত্ন করে রেখে দিও পরে কাজে লাগবে।
রিয়া অমল কান্তি বাবুর পদস্পর্শ করে বলে- স্যার দাদু আশীর্বাদ করো আমিও যেন তোমার মতো অঙ্ক শিখতে পারি আর তোমার মতোই মিনি ম্যালিস্ট হতে পারি।